Log in
Latest topics
Who is online?
In total there are 25 users online :: 0 Registered, 0 Hidden and 25 Guests None
Most users ever online was 45 on Fri Jan 08, 2021 4:00 am
Statistics
We have 61 registered usersThe newest registered user is SHAMIMSOUND
Our users have posted a total of 22 messages in 21 subjects
স্মৃতি: ষোলই-ডিসেম্বর ঊনিশ শ’ একাত্তর:
Page 1 of 1
স্মৃতি: ষোলই-ডিসেম্বর ঊনিশ শ’ একাত্তর:
স্মৃতি: ষোলই-ডিসেম্বর ঊনিশ শ’ একাত্তর:
ষোলই ডিসেম্বরে লালবাগে এক বন্ধুর বাড়িতে ভাড়া থাকা কালীন আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ ঘটনাটি ঘটেছিলো। ছুটে বেরিয়ে এসেছিলাম। শুনেছিলাম পাকসেনারা সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে আত্মসমর্úণ করেছে। হাজার হাজার মানুষ ঘর থেকে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। তখন শীতকাল। পথে অসংখ্য মানুষ। শহীদ মিনারের দিকে যাচ্ছি। মুখে জয় বাংলা আর বঙ্গবন্ধুর শ্লোগান। মাঝে মাঝে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জীপ কিংবা কনভয় রাস্তায় দেখা যাচ্ছে। তাদের দেখে পথচারীরা হাততালি দিয়ে উঠছে। কেউ ফুলের মালা ছুঁড়ে দিচ্ছে, কেউ কেউ গাড়ি থামিয়ে তাদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে, কোলাকুলি করছে। আমার কাছে এক প্যাকেট সিগারেট ছিলো। হঠাৎ একটি গাড়িভর্তি ভারতীয় বাহিনী এলে সেটি ছুঁড়ে দিলাম তাদের দিকে। তারা হাসতে হাসতে লুফে নিলো। অন্য পথচারীরা দৌড়ে দৌড়ে ওদের অনুসরণ করতে করতে গাড়ির পিছন থেকে হাতে হাত মিলাতে গেল।
—————————————————————–
হঠাৎ এক মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু আমার পোশাকের দিকে তাকিয়ে বেশ কড়া সুরে বলে উঠলো, খুব আরামেই ছিলে। আমরা যুদ্ধ করে মরি আর তোমরা দেখা যাচ্ছে কোট-টাই পরে বেশ আরাম-আয়েশেই ছিলে। তারপর দুহাতে বুকে জড়িয়ে ধরে হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো, ভাঙা গলায় আবার বলে উঠলো, আমরা সত্যিই কি স্বাধীনতা পেলাম আমরা কি সত্যিই স্বাধীন হলাম, না কি স্বপ্ন দেখছি।
—————————————————————-
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ঢাকায় ছিলাম। এতো ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে যেতে পারিনি। সেই সময় আমি কঠিন যক্ষা বা ক্ষয়কাশে ভুগছি।
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ সেই স্বাধীনতার ডাক শুনতে পারিনি। খুব অসুস্থ ছিলাম।
সেই ডাক শুনেছিলাম রেডিওতে। সে কী দারুণ উত্তেজনা আর আশঙ্কা। সবাই বলাবলি করছিলো বঙ্গবন্ধু যদি সরাসরি স্বাধীনতার ডাক দেন তাহলে পাক সেনারা সরাসরি মাঠে বোমা ফেলবে যেমন করে তারা বেলুচিস্তানে কিছুদিন আগে ফেলেছিলো। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এমন রাষ্ট্রনায়কোচিত দূরদর্শী কায়দায় স্বাধীনতার ডাক দিলেন যে তাতে তাদের পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব হলো না। কিন্তু পরে রাজনৈতিকভাবে যখন কিছুতেই পেরে উঠলো না তখন পচিশে মার্চের গভীর রাত থেকে মরণ কামড় শুরু করে দিলো। এর আগে গাজীপুরে ঊনিশে মার্চে প্রথম যুদ্ধ হয় পাক সেনাদের সঙ্গে, পরে খোলাখুলিভাবে পঁচিশে মার্চ থেকে। সারা শহর হঠাৎ করে প্রকম্পিত হতে থাকলো মূহুর্মূহু কামানের গোলার আওয়াজে। চারিদিক থেকে আর্ত মানুষের চীৎকার আর গোলাগুলির অফুরন্ত শব্দ, যেন সেইদিনই পৃথিবীর শেষ দিন। আমরা ছুটে ঘরের বাইরে, কেউ সোজা ছাদে। যে দিকে তাকাই সেই দিক আগুনের লেলিহান শিখা, সম্পূর্ণ আকাশ লালে লাল হয়ে উঠেছে। সারারাত ঘুম হয়নি। পরের দিন ঘুম থেকে উঠে দেখি অদ্ভুত এক দৃশ্য। সামনের রাস্তা দিয়ে দলে দলে মানুষ, সব বয়েসের ছেলে-মেয়ে বুড়ো-শিশু রিক্সায়, গাড়িতে কিংবা হেঁটে, বেশির ভাগ হেঁটে পুরনো ঢাকার দিকে চলেছে। যে যা পাচ্ছে হাতের কাছে, তাই নিয়েই তারা তাদের প্রিয় শহর ঢাকা ছেড়ে নদী পার হয়ে গ্রামের দিকে চলছে। এ যাওয়ার যেন কেনো শেষ নেই। আমার সব বন্ধু একে একে চলে যাচ্ছে। আমি অসুখের জন্যে কোথাও যেতে পারছি না। এইভাবেই নয়মাস ঢাকাতেই ছিলাম। প্রতি পদে পদে প্রতি দিন প্রতি রাত ভয়ে ভয়ে কেটেছে। এর মাঝে থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে খবর সংগ্রহ, টাকা-পয়সার জোগাড়, গরম কাপড় বাড়ি বাড়ি গিয়ে নেয়া, প্রচারপত্র বিলি, ঢাকা শহরের কিছু কিছু জায়গার ম্যাপ তৈরি ইত্যাদি ব্যাপারে সক্রিয় ছিলাম। আমরা কয়েকজন মিলে এইসব কাজ করতাম গোপন গোয়েন্দা সংস্থার মতো। সেই সময় সংসদ ভবনের কাছে একটি এতিমখানায় পাক সেনারা প্লেন থেকে বোমা ফেলে ধ্বংস করলো, অপপ্রচার চালালো যে এই কাজ দুষ্কৃতিকারী অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধারা করেছে। এরপর থেকে গভীর রাতে আকাশে কোনো প্লেনের শব্দ শুনলেই মনে হতো এই বুঝি আমাদের ঘরের ওপরই পড়লো। নয় মাসের প্রতিটি সময় এইভাবে কেটেছে। পাকিস্তানীরা তিরিশ লক্ষ নির্দোষ-নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যা করেছিলো। হিসেবে করলে দেখা যায় যে তারা প্রতিদিন প্রায় বারো হাজার মানুষ হত্যা করেছিলো, নয় মাস ধরে অর্থাৎ ২৬৭টি দিনে। এই সময় দুবার পাক-সেনারা আমাকে সন্দেহ করে ধরেছিলো। কিন্তু কপাল জোরে বেঁচে যাই। একবার কোট-টাই-ভালো পোশাক পরার সুবাদে আর একবার মানিব্যাগের ভেতর একটি ডাক টিকিটের আকারে পাকিস্তানী পতাকা পাওয়ার কারণে। এসব কারণে সব সময় বাধ্য হয়ে ভালো পোশাক পরে থাকতে হতো।
বঙ্গবন্ধুকে পাকিনস্তানীরা গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল। কেউ কেউ বললো, তাঁর ধরা পড়া ঠিক হয়নি। উনি ভারতে পালালেন না কেন। স্বাধীনতার ডাকও সরাসরি দিলেন না সাতই মার্চে। আর পাকিস্তানীদের অত্যাচারও তাঁর গ্রেপ্তারের কারণে থেমে থাকলো না। আসলে বঙ্গবন্ধু তো বিপ্লবী ছিলেন না যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে দেশ স্বাধীন করবেন। তিনি গণতান্ত্রিক উপায়ে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতার সঙ্গে ধাপে ধাপে এগিয়ে গিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে তার আত্মপ্রকাশ বিশ্ব মানচিত্রে বোধকরি প্রথম ও অনন্য একটি ঘটনা। এই ধারাবাহিকতার শুধু তিনি একা তৈরি করেননি, আমাদের জাতীয় নেতা শেরেবাংলা, ভাসানী, সোহরাওয়ার্দি সবাই করেছেন। তিনি শুধু নিজের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, আত্মত্যাগ আর আপসহীন সংগ্রাম এবং সাহসের কারণে শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেছিলেন।
চৌদ্দই ডিসেম্বরের বিকেলটা ভোলার নয়। হলিউডি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সিনেমার মতো ঢাকার আকাশে পাকিস্তানী আর ভারতীয় জঙ্গী বিমানের আকাশ-যুদ্ধ। অসম্ভব এক দৃশ্য! হঠাৎ একটি পাকিস্তানী প্লেন আঘাত পেয়ে কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে এবং উল্টোপুল্টি খেতে খেতে নদীর ওপারে কামরাঙ্গির চরের দিকে চলে যেতে থাকলো। মনে হলো আমাদের ছাদের ওপরেই ঘটনাটা ঘটবে। এপর বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখি জাহাজের ওই অবস্থা থেকেই পাকিস্তানী পাইলট ককপিট থেকে শূন্যে উঠে প্যারাসুট মেলে দিয়ে ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে এবং একটু পরে বিকট এক শব্দে চারদিক কেঁপে উঠলো অর্থাৎ প্লেনটি সজোরে মাটির ওপর আছড়ে পড়ে এক কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী সৃষ্টি করলো। সিনেমাহীন এই রকম অবাক-করা দৃশ্য অনেকের সঙ্গে নিজের চোখে দেখে আমরা আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠলাম। রক্তের মধ্য দিয়ে এক শিহরণ বয়ে গেল। সেই রাতটি আরও অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। ভারতীয় প্লেন রাতের অন্ধকারে সেনানিবাস আক্রমণ করেছিলো। সেই কারণে পাকিস্তানীরা হাউই ছুঁড়ে সারা উত্তর আকাশকে আলোকিত করে তুললো। ফট্ ফট্ আর প্লেনের সাঁই সাঁই বিকট শব্দ যেন একটি আনন্দ উৎসবের জন্যে যেন আলোর ফল্গুধারা। সে দৃশ্য ভোলা যায় না। মনে হচ্ছিলো রাতের অন্ধাকারে বাংলাদেশ নামে একটি নতুন দেশের জন্মলগ্নের আলোকিত আনন্দ-উৎসব।
ষোলই ডিসেম্বরে বিকেল বেলার দিকে শহীদ মিনারের সামনের রাস্তায় অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা হাতে রাইফেল এবং রণক্লান্ত চেহারা নিয়ে সমবেত হচ্ছেন। আমরা পথের দুধারে দাঁড়িয়ে তাদের হাততালি দিয়ে এবং কোলাকুলি করে বরণ করে নিচ্ছি। চোখে আনন্দাশ্রু। হঠাৎ এক মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু আমার পোশাকের দিকে তাকিয়ে বেশ কড়া সুরে বলে উঠলো, খুব আরামেই ছিলে। আমরা যুদ্ধ করে মরি আর তোমরা দেখা যাচ্ছে কোট-টাই পরে বেশ আরাম-আয়েশেই ছিলে। তারপর দুহাতে বুকে জড়িয়ে ধরে হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো, ভাঙা গলায় আবার বলে উঠলো, আমরা সত্যিই কি স্বাধীনতা পেলাম আমরা কি সত্যিই স্বাধীন হলাম, না কি স্বপ্ন দেখছি।
তখন চারিদিক মুক্তিযোদ্ধাদের রাইফেলের ঠা-ঠা গুলির আনন্দশব্দে প্রকম্পিত। সমবেত কণ্ঠে মাঝে মাঝে শোনা যেতে থাকলো জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনি।
লেখক-রবিউল হুসাইন
ষোলই ডিসেম্বরে লালবাগে এক বন্ধুর বাড়িতে ভাড়া থাকা কালীন আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ ঘটনাটি ঘটেছিলো। ছুটে বেরিয়ে এসেছিলাম। শুনেছিলাম পাকসেনারা সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে আত্মসমর্úণ করেছে। হাজার হাজার মানুষ ঘর থেকে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। তখন শীতকাল। পথে অসংখ্য মানুষ। শহীদ মিনারের দিকে যাচ্ছি। মুখে জয় বাংলা আর বঙ্গবন্ধুর শ্লোগান। মাঝে মাঝে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জীপ কিংবা কনভয় রাস্তায় দেখা যাচ্ছে। তাদের দেখে পথচারীরা হাততালি দিয়ে উঠছে। কেউ ফুলের মালা ছুঁড়ে দিচ্ছে, কেউ কেউ গাড়ি থামিয়ে তাদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে, কোলাকুলি করছে। আমার কাছে এক প্যাকেট সিগারেট ছিলো। হঠাৎ একটি গাড়িভর্তি ভারতীয় বাহিনী এলে সেটি ছুঁড়ে দিলাম তাদের দিকে। তারা হাসতে হাসতে লুফে নিলো। অন্য পথচারীরা দৌড়ে দৌড়ে ওদের অনুসরণ করতে করতে গাড়ির পিছন থেকে হাতে হাত মিলাতে গেল।
—————————————————————–
হঠাৎ এক মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু আমার পোশাকের দিকে তাকিয়ে বেশ কড়া সুরে বলে উঠলো, খুব আরামেই ছিলে। আমরা যুদ্ধ করে মরি আর তোমরা দেখা যাচ্ছে কোট-টাই পরে বেশ আরাম-আয়েশেই ছিলে। তারপর দুহাতে বুকে জড়িয়ে ধরে হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো, ভাঙা গলায় আবার বলে উঠলো, আমরা সত্যিই কি স্বাধীনতা পেলাম আমরা কি সত্যিই স্বাধীন হলাম, না কি স্বপ্ন দেখছি।
—————————————————————-
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ঢাকায় ছিলাম। এতো ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে যেতে পারিনি। সেই সময় আমি কঠিন যক্ষা বা ক্ষয়কাশে ভুগছি।
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ সেই স্বাধীনতার ডাক শুনতে পারিনি। খুব অসুস্থ ছিলাম।
সেই ডাক শুনেছিলাম রেডিওতে। সে কী দারুণ উত্তেজনা আর আশঙ্কা। সবাই বলাবলি করছিলো বঙ্গবন্ধু যদি সরাসরি স্বাধীনতার ডাক দেন তাহলে পাক সেনারা সরাসরি মাঠে বোমা ফেলবে যেমন করে তারা বেলুচিস্তানে কিছুদিন আগে ফেলেছিলো। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এমন রাষ্ট্রনায়কোচিত দূরদর্শী কায়দায় স্বাধীনতার ডাক দিলেন যে তাতে তাদের পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব হলো না। কিন্তু পরে রাজনৈতিকভাবে যখন কিছুতেই পেরে উঠলো না তখন পচিশে মার্চের গভীর রাত থেকে মরণ কামড় শুরু করে দিলো। এর আগে গাজীপুরে ঊনিশে মার্চে প্রথম যুদ্ধ হয় পাক সেনাদের সঙ্গে, পরে খোলাখুলিভাবে পঁচিশে মার্চ থেকে। সারা শহর হঠাৎ করে প্রকম্পিত হতে থাকলো মূহুর্মূহু কামানের গোলার আওয়াজে। চারিদিক থেকে আর্ত মানুষের চীৎকার আর গোলাগুলির অফুরন্ত শব্দ, যেন সেইদিনই পৃথিবীর শেষ দিন। আমরা ছুটে ঘরের বাইরে, কেউ সোজা ছাদে। যে দিকে তাকাই সেই দিক আগুনের লেলিহান শিখা, সম্পূর্ণ আকাশ লালে লাল হয়ে উঠেছে। সারারাত ঘুম হয়নি। পরের দিন ঘুম থেকে উঠে দেখি অদ্ভুত এক দৃশ্য। সামনের রাস্তা দিয়ে দলে দলে মানুষ, সব বয়েসের ছেলে-মেয়ে বুড়ো-শিশু রিক্সায়, গাড়িতে কিংবা হেঁটে, বেশির ভাগ হেঁটে পুরনো ঢাকার দিকে চলেছে। যে যা পাচ্ছে হাতের কাছে, তাই নিয়েই তারা তাদের প্রিয় শহর ঢাকা ছেড়ে নদী পার হয়ে গ্রামের দিকে চলছে। এ যাওয়ার যেন কেনো শেষ নেই। আমার সব বন্ধু একে একে চলে যাচ্ছে। আমি অসুখের জন্যে কোথাও যেতে পারছি না। এইভাবেই নয়মাস ঢাকাতেই ছিলাম। প্রতি পদে পদে প্রতি দিন প্রতি রাত ভয়ে ভয়ে কেটেছে। এর মাঝে থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে খবর সংগ্রহ, টাকা-পয়সার জোগাড়, গরম কাপড় বাড়ি বাড়ি গিয়ে নেয়া, প্রচারপত্র বিলি, ঢাকা শহরের কিছু কিছু জায়গার ম্যাপ তৈরি ইত্যাদি ব্যাপারে সক্রিয় ছিলাম। আমরা কয়েকজন মিলে এইসব কাজ করতাম গোপন গোয়েন্দা সংস্থার মতো। সেই সময় সংসদ ভবনের কাছে একটি এতিমখানায় পাক সেনারা প্লেন থেকে বোমা ফেলে ধ্বংস করলো, অপপ্রচার চালালো যে এই কাজ দুষ্কৃতিকারী অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধারা করেছে। এরপর থেকে গভীর রাতে আকাশে কোনো প্লেনের শব্দ শুনলেই মনে হতো এই বুঝি আমাদের ঘরের ওপরই পড়লো। নয় মাসের প্রতিটি সময় এইভাবে কেটেছে। পাকিস্তানীরা তিরিশ লক্ষ নির্দোষ-নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যা করেছিলো। হিসেবে করলে দেখা যায় যে তারা প্রতিদিন প্রায় বারো হাজার মানুষ হত্যা করেছিলো, নয় মাস ধরে অর্থাৎ ২৬৭টি দিনে। এই সময় দুবার পাক-সেনারা আমাকে সন্দেহ করে ধরেছিলো। কিন্তু কপাল জোরে বেঁচে যাই। একবার কোট-টাই-ভালো পোশাক পরার সুবাদে আর একবার মানিব্যাগের ভেতর একটি ডাক টিকিটের আকারে পাকিস্তানী পতাকা পাওয়ার কারণে। এসব কারণে সব সময় বাধ্য হয়ে ভালো পোশাক পরে থাকতে হতো।
বঙ্গবন্ধুকে পাকিনস্তানীরা গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল। কেউ কেউ বললো, তাঁর ধরা পড়া ঠিক হয়নি। উনি ভারতে পালালেন না কেন। স্বাধীনতার ডাকও সরাসরি দিলেন না সাতই মার্চে। আর পাকিস্তানীদের অত্যাচারও তাঁর গ্রেপ্তারের কারণে থেমে থাকলো না। আসলে বঙ্গবন্ধু তো বিপ্লবী ছিলেন না যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে দেশ স্বাধীন করবেন। তিনি গণতান্ত্রিক উপায়ে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতার সঙ্গে ধাপে ধাপে এগিয়ে গিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে তার আত্মপ্রকাশ বিশ্ব মানচিত্রে বোধকরি প্রথম ও অনন্য একটি ঘটনা। এই ধারাবাহিকতার শুধু তিনি একা তৈরি করেননি, আমাদের জাতীয় নেতা শেরেবাংলা, ভাসানী, সোহরাওয়ার্দি সবাই করেছেন। তিনি শুধু নিজের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, আত্মত্যাগ আর আপসহীন সংগ্রাম এবং সাহসের কারণে শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেছিলেন।
চৌদ্দই ডিসেম্বরের বিকেলটা ভোলার নয়। হলিউডি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সিনেমার মতো ঢাকার আকাশে পাকিস্তানী আর ভারতীয় জঙ্গী বিমানের আকাশ-যুদ্ধ। অসম্ভব এক দৃশ্য! হঠাৎ একটি পাকিস্তানী প্লেন আঘাত পেয়ে কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে এবং উল্টোপুল্টি খেতে খেতে নদীর ওপারে কামরাঙ্গির চরের দিকে চলে যেতে থাকলো। মনে হলো আমাদের ছাদের ওপরেই ঘটনাটা ঘটবে। এপর বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখি জাহাজের ওই অবস্থা থেকেই পাকিস্তানী পাইলট ককপিট থেকে শূন্যে উঠে প্যারাসুট মেলে দিয়ে ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে এবং একটু পরে বিকট এক শব্দে চারদিক কেঁপে উঠলো অর্থাৎ প্লেনটি সজোরে মাটির ওপর আছড়ে পড়ে এক কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী সৃষ্টি করলো। সিনেমাহীন এই রকম অবাক-করা দৃশ্য অনেকের সঙ্গে নিজের চোখে দেখে আমরা আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠলাম। রক্তের মধ্য দিয়ে এক শিহরণ বয়ে গেল। সেই রাতটি আরও অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। ভারতীয় প্লেন রাতের অন্ধকারে সেনানিবাস আক্রমণ করেছিলো। সেই কারণে পাকিস্তানীরা হাউই ছুঁড়ে সারা উত্তর আকাশকে আলোকিত করে তুললো। ফট্ ফট্ আর প্লেনের সাঁই সাঁই বিকট শব্দ যেন একটি আনন্দ উৎসবের জন্যে যেন আলোর ফল্গুধারা। সে দৃশ্য ভোলা যায় না। মনে হচ্ছিলো রাতের অন্ধাকারে বাংলাদেশ নামে একটি নতুন দেশের জন্মলগ্নের আলোকিত আনন্দ-উৎসব।
ষোলই ডিসেম্বরে বিকেল বেলার দিকে শহীদ মিনারের সামনের রাস্তায় অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা হাতে রাইফেল এবং রণক্লান্ত চেহারা নিয়ে সমবেত হচ্ছেন। আমরা পথের দুধারে দাঁড়িয়ে তাদের হাততালি দিয়ে এবং কোলাকুলি করে বরণ করে নিচ্ছি। চোখে আনন্দাশ্রু। হঠাৎ এক মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু আমার পোশাকের দিকে তাকিয়ে বেশ কড়া সুরে বলে উঠলো, খুব আরামেই ছিলে। আমরা যুদ্ধ করে মরি আর তোমরা দেখা যাচ্ছে কোট-টাই পরে বেশ আরাম-আয়েশেই ছিলে। তারপর দুহাতে বুকে জড়িয়ে ধরে হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো, ভাঙা গলায় আবার বলে উঠলো, আমরা সত্যিই কি স্বাধীনতা পেলাম আমরা কি সত্যিই স্বাধীন হলাম, না কি স্বপ্ন দেখছি।
তখন চারিদিক মুক্তিযোদ্ধাদের রাইফেলের ঠা-ঠা গুলির আনন্দশব্দে প্রকম্পিত। সমবেত কণ্ঠে মাঝে মাঝে শোনা যেতে থাকলো জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনি।
লেখক-রবিউল হুসাইন
Page 1 of 1
Permissions in this forum:
You cannot reply to topics in this forum
Fri Mar 05, 2010 7:20 pm by gurubhai
» ইমেইল এ্যাকাউন্ট মুছে ফেলা
Tue Jan 26, 2010 7:50 pm by Admin
» ল্যাপটপের সাধারণ যত্নআত্তি:
Tue Jan 26, 2010 7:46 pm by Admin
» স্বাধীনতা যুদ্ধের বীরনারীদের অবদান
Tue Jan 26, 2010 7:11 pm by Admin
» স্মৃতি: ষোলই-ডিসেম্বর ঊনিশ শ’ একাত্তর:
Tue Jan 26, 2010 7:09 pm by Admin
» জঙ্গিরা এ দেশে কী চায়?
Tue Jan 26, 2010 7:03 pm by Admin
» ১৯৭৭ সালের টাকা
Tue Jan 26, 2010 6:53 pm by Admin
» ১৯৭৪ সালের টাকা
Tue Jan 26, 2010 6:51 pm by Admin
» ১৯৭৩ সালের টাকা
Tue Jan 26, 2010 6:49 pm by Admin